ফুরফুরা শরীফ: ইসলামিক কালচার ও দাদা হুজুরের ইতিহাস

|
ফুরফুরা শরীফ:

ফুরফুরা শরীফ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার জাঙ্গিপাড়া ব্লকে অবস্থিত, একটি পবিত্র ইসলামী তীর্থস্থান ও সুফি দরগাহ হিসেবে বিখ্যাত। এটি সুন্নি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা সিলসিলা-ই-ফুরফুরা শরীফ নামে পরিচিত এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.), যিনি দাদা হুজুর নামে সমাদৃত।

এই দরবার শরীফটি ১৩৭৫ সালে মুকলিশ খানের নির্মিত একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে আধুনিক স্থাপত্যে রূপান্তরিত হয়। ফুরফুরা শরীফ ভারত ও বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত, যেখানে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে ঈসালে সাওয়াব মাহফিলে লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম করেন।

দাদা হুজুর হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) ১৮৫৯/১৮৬০ সালে ফুরফুরা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি শৈশব থেকেই অসাধারণ মেধা ও ধর্মীয় প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি হুগলি মোহসিনীয়া মাদ্রাসা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকাহ ও তরিকতের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং মদিনা শরীফে গিয়ে ৪০টি হাদিস গ্রন্থের সনদ লাভ করেন।

আবু বকর সিদ্দিকী শরিয়ত ও তরিকতের সমন্বয়ে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং তাঁকে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ভারত ও বাংলাদেশে হাজারো মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা ও দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

তাঁর পাঁচ পুত্র আবদুল হাই সিদ্দিকী, আল্লামা আবু জাফর সিদ্দিকী, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, নাজমুস সায়াদাত সিদ্দিকী ও জুলফিকার আলী সিদ্দিকী—তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং পাঁচ হুজুর কেবলা নামে পরিচিত হন। তাঁরা দুই বাংলায় ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ফুরফুরা শরীফে প্রতি বছর উরস মেলা বা ঈসালে সাওয়াব উৎসব লক্ষাধিক মানুষকে আকর্ষণ করে, যেখানে ধর্মীয় আলোচনা, মুরিদদের দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে।

হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’-এর একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, যা ভারতের

স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করত। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমান-ই-ওয়াজিন-ই-বাংলা’ বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত

করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করেন।

দেশের জন্য দাদা হুজুরের অবদান

দাদা হুজুর শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবেই নয়, একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও দেশের জন্য অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি শিক্ষার প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং হাজারো মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যা সমাজের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে সহায়তা করে।

নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অভূতপূর্ব, কারণ তিনি মেয়েদের জন্য পৃথক মাদ্রাসা ও শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেন। তিনি এতিমখানা ও দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করেন।

তাঁর সামাজিক কার্যক্রম দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নেও সহায়ক ছিল। তাঁর প্রচারিত শান্তি ও সহাবস্থানের বাণী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।

আব্বাস সিদ্দিকী: তিনি ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা এবং একজন বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব। তিনি দাদা হুজুর পীর কেবলা (রহ.)এর বংশধর।

আব্বাস সিদ্দিকী ফুরফুরা শরীফের ঐতিহ্য ও শিক্ষা প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

Leave a Comment