ফুরফুরা শরীফ পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া ব্লকে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ সুফি তীর্থস্থান ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। এটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক সম্মানিত মাজার হিসাবে বিবেচিত হয়, আজমির শরীফের পরেই । ১৩৭৫ সালে মুকলিশ খানের নির্মিত একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে এই দরবারের যাত্রা শুরু হয়। তবে এর ইতিহাস আরও প্রাচীন—স্থানীয় বাগদি (বার্গা ক্ষত্রিয়) রাজার শাসনামলে এই অঞ্চলটি “বালিয়া-বাসন্তী” নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম সেনাপতি জাফর খান গাজীর নেতৃত্বে সংঘটিত এক যুদ্ধে বাগদি রাজার পরাজয়ের পর অঞ্চলটির নামকরণ হয় “পুরফরা” (পরবর্তীতে “ফুরফুরা”), যা স্থানীয়দের মতে “পূর্ণ আনন্দ”-এর প্রতীক ।
প্রতিষ্ঠাতা ও ধর্মীয় নেতৃত্ব
১৯০০ সালের দিকে পীর আবু বকর সিদ্দিকী ফুরফুরা শরীফকে একটি সুসংগঠিত আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তরিত করেন। তাঁকে “মুজাদ্দিদে জামান” (যুগের সংস্কারক) বলা হয়। তিনি ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি নারীশিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত “সিদ্দিকা উচ্চ বিদ্যালয়” নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে । আবু বকরের পাঁচ পুত্র—আবদুল হাই সিদ্দিকী, আবু জাফর সিদ্দিকী, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, নাজমুস সায়াদাত সিদ্দিকী ও জুলফিকার আলী সিদ্দিকী—পরবর্তীতে দরবারের নেতৃত্ব দেন এবং “পাঁচ হুজুর কেবলা” নামে খ্যাত হন ।
শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক অবদান*
ফুরফুরা শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর শিক্ষা ও সমাজকর্ম। আবু বকর সিদ্দিকী দরিদ্র ছাত্রদের বিনামূল্যে বোর্ডিং সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসাকেন্দ্র, এতিমখানা এবং ইসলামি পত্রিকা প্রকাশে সহায়তা করেন। তাঁর পুত্র আবদুল হাই সিদ্দিকী ২০শ শতকে “ইসলাম মিশন”, “পশ্চিমবঙ্গ সিদ্দিকীয়া গার্লস হাই মাদ্রাসা” এবং ঢাকার মীরপুরে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও, স্বাধীনতা আন্দোলনে এই পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ।
উরসের মেলা: আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির মিলন
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ২১-২৩ তারিখে (ইংরেজি মার্চের ৫-৭ তারিখ) ফুরফুরা শরীফে উরসের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়, যেখানে আধ্যাত্মিক discourses, ইসলামি সঙ্গীত এবং স্থানীয় কারুশিল্পের প্রদর্শনী দেখা যায়। মেলাটি স্থানীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করে এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয় ।
বিতর্ক ও ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন
ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে দাবি করা হয়, মুসলিম বিজয়ের সময় হিন্দু বাগদি রাজার রাজবাড়ি দখল করে এই দরবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ সম্পর্কিত বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, সুফি শাহ হোসেন বোখারী (রহ.) কৌশলগতভাবে বাগদি রাজাকে পরাজিত করে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নেন । যদিও দরবারের আনুষ্ঠানিক ইতিহাসে এই ঘটনাকে “ধর্মীয় বিজয়” হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ*
বর্তমানে ফুরফুরা শরীফ কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবেরও উৎস। আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত “ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট” (ISF) এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে দরবারের মূল পরিচয় এখনও শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা এবং সম্প্রীতি রক্ষার সংগ্রামে নিবেদিত ।
উপসংহার
ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস ধর্মীয় সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার এবং সামাজিক ন্যায়ের এক জটিল ও সমৃদ্ধ কাহিনী। এটি ভারতের সুফি ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত উদাহরণ, যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও মানবসেবা একাকার। যদিও এর ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর প্রভাব ও অবদান অপরিসীম।